সাঁইথিয়া বইমেলায় চিত্র প্রদর্শনী

।। গত ২৯ শে ডিসেম্বর থেকে সাঁইথিয়া বই মেলা শুরু হয়েছে। সেখানেই চলছে অনির্বান সেনের একক আলোকচিত্র প্রদর্শণী। সেই প্রদর্শণী মন কেড়েছে মেলায় আসা দর্শকদের। নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক ডঃ গৌতম সেন এসেছিলেন এই প্রদর্শণীতে। অধ্যাপনার বাইরে তিনি নিজেও একজন আলোকচিত্রী।প্রদর্শণী ঘুরে জানালেন তাঁর মতামত ।।
ছবিতে গল্প, কথক অনির্বাণ
সাঁইথিয়া বই মেলা নিয়ে উৎসাহের অন্ত নেই সাঁইথিয়ার বইপ্রেমী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
সাঁইথিয়া পৌরসভার উদ্যোগে শহরের অষ্টম বইমেলা চলছে শশিভূষণ দত্ত গার্লস হাইস্কুলের মাঠে। আর তাকে কেন্দ্র করে রোজ শহরের উৎসাহী শিল্পীরা আর সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি পেশ করছে নিত্যনতুন অনুষ্ঠান। তবে সবকিছু ছাপিয়ে নজর কাড়ছে অনির্বাণ সেনের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। বাচ্চা থেকে বড়, সাধারণ দর্শক থেকে মেলার অনুষ্ঠানে আসা শিল্পী, অনির্বাণের প্রদর্শনী দেখেনি এমন কাউকে মেলায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। শহরে এই জিনিস নতুন হচ্ছে তা কিন্তু নয়।
সাঁইথিয়ায় বইমেলা ট্র্যাডিশন শুরুর একদম প্রথম দিকে অনির্বাণের ছবির প্রদর্শনী দুই-এক বার হয়েছিল বটে। কিন্তু তখন এত ছবি দেখার হিড়িক ছিল না। ছিল না ছবি তোলারও হিড়িক। আজকাল মোবাইল ক্যামেরার দৌলতে যেমন বাড়ছে ছবি তোলার হিড়িক, বাড়ছে ছবি দেখারও হিড়িক।
অনির্বাণের প্রদর্শনীতে তাই দেখতে পাওয়া গেল এমন কিছু ছবি-উৎসাহীর যারা হাতে দামী ব্র্যান্ডের ক্যামেরা নেওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তা সাধ্যের বাইরে, অথচ মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে তাদের উৎসাহ অনেক। এদের অনেককেই দেখা গেল অনির্বাণ ছবিওয়ালার সাথে একবার কথা বলার সুযোগ খুঁজতে। কারণটা বোঝা যাবে যদি একবার অনির্বাণের প্রদর্শনী ঘুরে আসা যায়। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় ছবি তোলার গলিঘুঁজি শিখে আর খবরের কাগজের জন্য ছবি তুলে নিজের হাত পাকিয়ে শিল্পী এখন অনেক পরিণত। টেকনিক আর আবেগের নিয়ন্ত্রিত সংমিশ্রণে প্রদর্শনীর ছবিগুলিতে সরল গীতিকাব্যের বাঙময়তা ফুটে উঠেছে। ফটোগ্রাফির আসল অর্থ যে ছবির মধ্যে গল্প বলা, শিল্পীর ছবিতে তার যথার্থতা প্রমাণিত। সাম্প্রতিক তোলা ও প্রদর্শনীর জন্য বাছাই করা চল্লিশটি ছবিকে মোটামুটি কতকগুলি সিরিজে ভাগ করা যায়ঃ পোরট্রেইট, পাতা, কাক, হিউম্যান অবজেক্ট, প্রকৃতি, স্টিল লাইফ আর সাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। এই সব ধরনের বিভাগে শিল্পী স্বচ্ছন্দ বিচরণ করলেও সবছেয়ে নজর কেড়েছে তার পাতা আর কাক সিরিজের ছবি। হিচককের “দ্য বার্ডস” ছবির মত আক্রমণাত্বক নয়, অনির্বাণের কাকেরা মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির মত সংসারী ও আড্ডাপ্রিয়। লো লাইট ফটোগ্রাফিতে সিল্যুয়েটের গুরুত্বই আলাদা। সবচেয়ে মজার, কাকেদের সব ছবিকেই মোনোক্রোম সিল্যুয়েটের মাধ্যমে ধরা হয়েছে, তাই কাকেদের জৈবিক পরিচয় ভেঙ্গে নান্দনিক রূপের প্রকাশ অনির্বাণের ছবিতে। আর পাতা সিরিজের ছবিগুলি শুধু রঙের খেলায় মেতেছে তা নয়, আলোছায়ার রহস্যময়তা ছবিগুলিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। নজর কাড়ে বাঁশপাতার ছবি। তারের উপরে বসা বাঁশপাতি পাখির ছবি তবে নেই অনির্বাণের সংগ্রহে। তবে আছে তারের উপর বসা একদল পাখির ছবি, অনলাইন থাকার যুগে পাখিদেরও অনলাইন থাকা আর কি। এভাবেই পাওয়া যায় পিঁপড়ের ছবি, হলুদ ফুলের উপর কালো পিঁপড়ের সিল্যুয়েট যেন। সিল্যুয়েটে ফুটেছে হিউম্যান অবজেক্ট।
নদীর জলের পটভূমিকায় একদল মানুষের ছবি। কুয়াশার মধ্যে পড়া মানুষের সিল্যুয়েট। হিউম্যান অবজেক্ট সিরিজের প্রতিটি ছবিই কোনো না কোনো অর্থ বহন করে চলেছে। প্রতিটি ছবিই বহমান জীবনের কথা বলে। প্রতিটি ছবিই কম্পোজিশনের গুণে অনবদ্য। তবে একসারি তালগাছের ছবিতে কোনো প্রাণী বা মানুষের উপস্থিতি থাকলে ছবিটির একঘেয়েমি কাটতো বলে মনে হয়। স্টিল লাইফের ছবির মধ্যে এক অদ্ভুত কোণ থেকে নেওয়া ভাঙ্গা ঘরের ছবিটি প্রশংসনীয়। সেটি যেন সত্যই ভাঙ্গা সময়, ভাঙ্গা ঘরের কথা, আর তার মধ্যে মানুষের বন্দীদশার কথা বলে।
অনির্বাণের সব ছবিতেই ধরা পড়ে এক শিল্পীসুলভ নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গতা না থাকলে শিল্প সাধনা যেমন সম্ভব নয়, নিঃসঙ্গতা তেমন যেন শিল্পী কে ছেড়েও যেতে চায় না। কাকেদের ছবিই হোক বা পাতাদের ছবি, মানুষের ছবিই হোক বা পিঁপড়ের ছবি, সাবজেক্ট কিন্তু নিঃসঙ্গ। আর নিঃসঙ্গতার ওষুধ একটাইঃ ভালবাসা। একসারি জোড়ায় জোড়ায় জ্বলন্ত মোমবাতির ছবিতে প্রতি মোমবাতি যেন বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তার পাশের প্রিয়জনকে অনন্তকাল ধরে প্রেম নিবেদন করছে। জেনেই হোক বা না জেনেই, অনির্বাণ যেন জন কিটস এর “ওড অন আ গ্রেসিয়ান আর্ন” কবিতার ফটোগ্রাফিক ফ্রিজিং-এ ধরা প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের অনন্ত প্রেম নিবেদনকেই ছবিতে তুলে এনেছেন। যেমন কিটস-এর কবিতার মোহময়ী নারী ধরা পড়েছে অনির্বাণের পোরট্রেইট সিরিজে। চোখ যেখানে কথা বলে। আলোছায়ার খেলা নারীকে যেখানে রহস্যময়ী করে তোলে। ছবিগুলির নিচে “নট ফর সেল” লেখা থাকায় অনেক উৎসাহী পুরুষ দর্শক হয়ত বা মনে মনে আঘাত ও পেয়ে থাকতে পারেন। তবে আঘাত পাওয়া মন আরাম পাবে বাচ্চা একটি মেয়ের পোরট্রেইট-এ। এক সরল শিশুর কৌতূহলী চোখ ছবিটিকে অসামান্য বাঙময় করে তুলেছে।
অনির্বাণের প্রদর্শনীর অন্য এক পাওনা হল ক্যাপশন। যদিও সব ক্যাপশন একশ শতাংশ মানানসই বলে মনে হয় না, তবে বিখ্যাত কবিদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা উক্তির চয়ন অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে ছবিগুলির অর্থবহতা ক্যাপশনগুলিকে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত সংযোজন বলে মনে করিয়ে দেয়। অনির্বাণের এইরকম ছবির মধ্যে গল্প বলার ক্ষমতা সত্যিই ধন্য হয় যখন বুদ্ধদেব গুহের মত গল্পকারের হাতে তার এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়।