আজ শিশু দিবস – আজ শিশু দি বস। পরন্তু…

অনির্বাণ সেন, সাঁইথিয়াঃ
কিঁউ কি…
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটি গান আছে। সেই গানের কয়েকটা লাইন হলো-
‘ শিশু মেলা, শিশু দিন, শিশু বৎসর
কত মধু মাখা দুই ছাপা অক্ষর-
আলো ঝলমল সভা ভাবের জোয়ার
তবু ভবিষ্যতেরা খাটে ভূতের বেগার’। সত্যিই তো। উনার কথা তো ঠিকই। যেমন ধরুন না-
রুবেল সেখ (আসল নাম না। পরিবর্তিত নাম)। বয়স খুব বেশি হলে বছর দশেক। বাড়ি ময়ূরেশ্বর থানা এলাকা। বাবা মায়ের চতুর্থ সন্তান। প্রাইমারীতে ভর্তী হয়েছিল। তবে প্রাইমারীর গণ্ডি পেরাতে পারেনি। স্কুল ছাড়তে হয়েছে। বাবা ট্রলি (পণ্যবাহী ভ্যান রিক্সা) চালান। মা সংসার সামলে কখনো বিড়ি বাঁধতে এখানে ওখানে যান। কখনো পরের বাড়িতে গৃহ পরিচারীকার কাজ করেন। যখন যা জুটে তাই করেন। এহেন সংসারে রুবেলদের পড়াশোনা করে বড়ো হওয়া খুব কঠিন। রুবেলও পারলো না। এখন সারাদিন একটা চায়ের দোকানে কাজ করে দিনের শেষে মায়ের হাতে কুড়ি টাকা তুলে দেয়। এখন থেকেই শিখতে শুরু করেছে জীবন যুদ্ধের প্রথম পাঠ।
তপন দাস (আসল নাম না। পরিবর্তিত নাম)। বয়স বারো। সাঁইথিয়া থানা এলাকায় বাড়ি। গাড়ি সারানোর গ্যারেজে কাজ করে। বাবা নেশা করত। বাবার ভালোবাসা কী জানতেই পারলো না। যখন তার সাত বছর বয়স – মদে খেয়ে নিল তপনের বাবাকে। দুই দিদি আর মায়ের সংসারে এখন প্রধান রোজগেরে তপন। দিনের শেষে মায়ের হাতে তুলে দেয় ১০০-১৫০ টাকা। যেদিন যেমন হয় সেদিন তেমন।
চামেলী খাতুন (এও আসল নাম না। পরিবর্তিত নাম)। সকাল থেকে লাইনের হোটেলে আনাজ কাটে, এঁটো বাসন ধোয় – আর রাত ৮ টা বাজতেই চলে যায় লাইন হোটেলের পেছন দিকের ঝুপড়িতে। ঘণ্টায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। রোজগারের অর্ধেক তাঁর অর্ধেক লাইন হোটেল মালিকের। পুলিশের ঝামেলা মেটানোর টাকাও তাঁর। এমন কি সারা মাসের ট্যাবলেট কেনার দামটাও। চামেলীর বয়স নিজেও জানেনা। আন্দাজ ষোলো – সতের। প্রতি মাসে বাড়ি থেকে লোক এসে টাকা নিয়ে যায়। বাড়ির খরচ চালানোর জন্যে।
এ তো কয়েকটা উদাহরণ মাত্র। দোকানের শোকেসে সাজানো স্যাম্পেল। আপনারাই খোঁজ নিয়ে দেখুন এ রকম রুবেল, তপন, চামেলীর মতন আরো অনেক রুবেল, তপন, চামেলীর খোঁজ পাবেন।এমন কি এই আজকের দিন এই শিশু দিবসের দিনেও খোঁজ নিয়ে দেখুন চিত্রটা এক ফোঁটাও পাল্টাইনি।
আজ ১৪ নভেম্বর। শিশু দিবস। প্রতি বছর মতন আজও সারা দেশ জুড়ে পালন করা হচ্ছে এই শিশু দিবস। আজ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিন। কিছু তথ্য বলা যাক। আজকের দিনের কথা নিয়ে-
আগে কিন্তু এই ১৪ নভেম্বর শিশু দিবস পালন করা হতো না। সেটা হতো ২০ নভেম্বর। জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে। ইউনাইটেড নেশানের পর্যবেক্ষণে। ১৯৬৪ সালে আজকের দিনে মারা যান স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু (জন্ম নভেম্ভর ১৪, ১৯৮৯)। তারপর থেকেই উনার মৃত্যু দিন টিকে স্মরণ করে রাখতেই আজকের দিনটিকে ভারতে ‘বাল দিবস’ বা ‘শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। যদিও শিশু দিবসটি প্রথমবার তুরস্কে পালিত হয়েছিল সাল ১৯২০র ২৩ এপ্রিল তারিখে। বিশ্ব শিশু দিবস নভেম্বর ২০শে উদযাপন করা হয়, এবং আন্তর্জাতিক শিশু দিবস জুন ১ তারিখে উদযাপন করা হয়। বিশ্বব্যাপী শিশুদের সম্মান করতে শিশু দিবস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় পালিত হয়ে থাকে।
নেহেরু ছিলেন শিশুদের খুব প্রিয় একজন। শিশুরাও ছিল চাচা নেহেরুর প্রাণের ধন – চোখের মণি। ছোটদের জন্যে তিনি একসময় বলেছিলেন “The children of today will make the India of tomorrow. The way we bring them up will determine the future of the country”.
আজকের দিনে কত স্লোগান। সোস্যাল মিড়িয়া থেকে স্কুলের ক্লাস রুমের ব্ল্যাক বোর্ডে। ছোটো ছেলেদের হাতে ধরা স্লোগান ‘Children are too small to earn money’, ‘Let them earn knowledge not money’, ‘Let them to enjoy their childhood’, বা Today’s children are tomorrow’s future’!!!!
সত্যিই কি আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ? সারা ভারত যেমন দু’ভাগে বিভক্ত শিশুরাও ঠিক দু’ভাগে বিভক্ত। হারিয়ে যাচ্ছে চাচা নেহেরুর স্বপ্ন। টিকিট কেটে পার্কে ঢুকছে এক শ্রেণির শিশুরা। আর এক শ্রেণির শিশুরা বাইরে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য বাদাম ভাজা নিয়ে। ওরা বাদাম খেলে তবে তাদের পেট একটু গড়ম ভাতের গন্ধ পাবে। শিক্ষা সবার জন্যে। তবুও পেটের দায়ে স্কুল ছুট হলো রুবেলরা। লাইনের হোটেলে সন্ধ্যে তে উগ্র সাজে সেজে দাঁড়ায় চামেলীরা। এরপরও কিন্তু রুবেল, তপন, চামেলীরা বলে-
পড়াশোনায় জলাঞ্জলি ভেবে মূর্খ বলছ কি?
তোমরা বলছ আমাদের জীবনের চার আনাই ফাঁকি
ষোলো আনা থেকে যদি চার আনা যায়
হিসেব এসে দাঁড়ায় বারো আনাই
কিন্তু বারো আনাতে আমরা খুশি
আমাদের চাওয়া যে অনেক বেশি……